টবে ফুল চাষ

আমরা সকলেই সুন্দরের পুজারী। আর এ পৃথিবিতে ফুলের মত সুন্দর আর পবিত্র কোন কিছু নেই। তাইতো যুগে যুগে মানুষের কাছে ফুল সমাদ্রিত। এ পৃথিবী যা কিছু সুন্দর তার সমস্তটাই ফুলের সাথে তুলনীয়। আর তাইতো সাহিত্যের সর্বত্র ফুলের বিচরণ। পৃথিবীতে এমন মানুষ নেই যিনি ফুল পছন্দ করেন না। ফুল কেবল আনন্দই দেয় না শোভা বর্ধনের ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে ফুলের ব্যবহার ও চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফুলের রূপ লাবন্য ও সৌরভ চোখের ও মনের পিপাসা মেটায়। তাই প্রাগ ঐতিহাসিক যুগথেকে ফুল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগনিত। ফুলের সৌরভ এক দিকে যেমন মানুষকে বিমোহিত করে তেমনি এর সোন্দর্য বাড়ির পরিবেশকে করে তোলে আকর্ষণীয়। আর এতে বাড়ির মালিকের রুচি বোধেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একবিংশ শতাব্দির কর্ম ব্যস্ত মানুষের কর্মময় জীবনের কঠিন ও ব্যস্ততম পরিবেশ থেকে বাড়ি ফিরে ফুলের পরশে মানুষ খুঁজে পায় এক অনাবিল আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তি। এছাড়াও মনের যত দুঃখ, যাতনা, গ্নানি, অবসন্নতা নিমেষেই দূর করতে সাহায্য করে। নিজ হাতে উৎপাদিত ফুলের বৈচিত্র পারিবারিক আনন্দ বাড়িয়ে দেয়।

বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমরা যারা শহরে বাস করি তারা প্রশস্ত উঠোন আছে এমন বাড়ি ছেড়ে ফ্লাটে বসবাস করছি অথবা করার চিন্তা ভাবনা করছি। এর ফলে যে ঘটনাটি ঘটছে সেটি হল ফুল বাগান করার মত আর আমরা জায়গা পাচ্ছিনা। এতে যে একবিংশ শতাব্দিতে এসে মানুষ তার সৌন্দর্য বিকাশের পথটি হারিয়ে ফেলবে এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। তার কারন সভ্য সমাজের মানুষের মত ফুলও তার আদি বাসস্থান বাগান ছেড়ে জায়গা করে নিয়েছে রকমারি টবে। তবে টবে জায়গা করে নেয়ার ফলে যে লাভটি হয়েছে সেটি হল তার বিচরণ ক্ষেত্রে এবং যত্ন বেড়ে গিয়েছে। মানুষ এখন টবে ফুল গাছ লাগিয়ে খুব সহজেই তার মানসিক আত্ম তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারছে। শুধু তাই নয় এর ফলে ফুল গাছ এ দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ধনী সমাজে টবে ফুলের চাষ এখন একটি ফ্যাশানে পরিনত হয়েছে। তবে আমরা যা কিছুই বলি না কেন বর্তমানে টবে ফুল চাষের প্রতি মানুষের আগ্রহ যে দিন দিন বাড়ছে তা হলফ করে বলা যায়। আবার অনেকের টবে ফুল চাষের প্রাথমিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে চাষের ক্ষেত্রে কোন না কোন সমস্যায় পড়েছেন। আর এই তিক্ত অভিজ্ঞতা পুনরায় তাকে ফুল চাষে আকৃষ্ট করে না। তারপরেও কারো না কারো সাহায্য নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছে অনেকেই। সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে টবে ফুলের চাষকে স্বার্থক ও সুন্দর করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা উল্লেখ করতে পারি। তবে যাই হোক কোন কাজ করার আগে আমাদের হাতে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের একটি গাইড থাকে তবে কাজের সফলতার সম্ভবনার পাল্লা ভারি হয়ে যায়। সে রকমই একটি গাইড হিসেবে টবে ফুলের চাষ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা হল।

টবে ফুল চাষের পূর্ব প্রস্তুতিঃ
গাছ বসানোর সফলতা নির্ভর করে সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বসানোর মাধ্যমে। কোন কিছু না ভেবে কাজ শুরু করার ফল অনেক সময় ভালোর চেয়ে মন্দই হয় বেশি। এই ধরনের অসফলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে আর্থিক, শারীরিক ও পরিবেশগত সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে টবে ফুলের চাষ শুরু করা। সব রকমের ফুলগাছ সকলের ভাল না লাগালেও গাছ বসানোর প্রয়োজনীয় জিনিস প্রায় সব গাছের জন্য একই হবে। প্রথমে চাই ভালো দোঁআশ মাটি, টব, পানি দেয়ার জন্য ঝাঝরি। নানা ধরনের পোকার আক্রমণে ফুলগাছ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য পোকা মারা ওষুধ। ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হ্যান্ড ¯েপ্রয়ার। গাছের ডাল ছাঁটাইয়ের জন্য সিকেচার বা কাঁচি এবং মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি। আর চাই গাছ বাঁধার পাটের সুতো, বাঁশের কাঠি। জৈবিক সার পচানোর জন্য মাটির গামলা, প্লাস্টিক বালতি, মগ ইত্যাদি। এই সমস্ত জিনিসগুলি সংগ্রহ করে রাখার প্রধান সুবিধা হচ্ছে দরকার পড়ার সাথে সাথে তা কাজে লাগানো যাবে।
না হলে গাছ আনার পর দেখা যাবে বসাবার টব নেই অথবা পোকার আক্রমণে গাছ শেষ হতে চলেছে কিন্তু পোকার আক্রমণ রোধ করার মতো কোন ওষুধ কাছে নেই। এ ছাড়াও টুকিটাকি অনেক কিছুর প্রয়োজন হবে এবং সেগুলি আস্তে আস্তে জোগাড় করে নিতে হবে। মূল কিছু উপকরণ আগের থেকে সংগ্রহ করে রাখাই ভাল।

কোন ফুল কখন লাগাবেনঃ
বিশাল উদ্ভিদ সাম্রাজ্যের সব কিছুই আপন নিয়মে চলে। নিয়মের ব্যতিক্রম বড় একটা দেখা যায় না। শরতের আগমন বার্তা ঘোষনাকারী কাশ ফুল শীতে ফোটে না। শীতের চন্দ্রমল্লিকা গরমে হয় না। ফুল, পাতাবাহারের নির্দিষ্ট আবহাওয়া প্রিয়তা থাকার ফলে ঋতু অনুসারে গাছের ফুল ফোটে। যে কোন ধরনের গাছ লাগিয়ে সফলতা পেতে হলে গাছগুলির বৃদ্ধি ও ফুল হওয়ার যথাযথ সময় জেনে রাখা উচিত। চারা লাগানো ও ফুল ফোটার প্রয়োজনীয় সময় সূচি নিচে দেওয়া হল। এই সাধারণ সময় সুচি কোনও প্রদর্শনীভিত্তিক নয়।

প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে গাছ করার সময় প্রদর্শনীর নির্ধারিত দিনের সঙ্গে নির্বাচিত গাছের প্রয়োজনীয় সময়ের হিসাব করে নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা, বাগানের মাটিতে লাগানো গাছের ফুল ফোটার সময় টবের গাছের চেয়ে দশ-বারো দিন সময় বেশি লাগবে।

শীত কালীন ফুল
ক্যামেলিয়া
পয়েনসেটিয়া
বোগেনভিলা
ডালিয়া(ম)
চন্দ্রমল্লিকা(ম)
কারনেশন(ম)
হলিহক(ম)
পিটুনিয়া(ম)
স্যালভিয়া(ম)
গোলাপ
জারবেরা
গাজানিয়া

গ্রীষ্ম কালীন ফুল

গন্ধরাজ
রজনীগন্ধা
জারবেরা
গাজানিয়া (ম)
সূর্যমুখী (ম)
জিনিয়া(ছোট) (ম)
পিটুনিয়া(ছোট) (ম)
সিলোসিয়া(ম)
বোগেনভিলা
“ম” চিহ্নটি একান্তভাবে মৌসুমী।

বর্ষা কালীন ফুল
বেল-সব ভ্যারাইটি
জুঁই- সব ভ্যারাইটি
চাঁপা- সব ভ্যারাইটি
মুসেন্ডা- সব ভ্যারাইটি
পোর্টল্যানডিয়া
দোপাটি
জিনিয়া ডবল
সুর্যমুখী (ছোট)
স্থল পদ্ম
হাইড্রানজিয়া

প্রায় সারা বৎসর ফুল হয়

কাঞ্চন (সাদা)
ধুতুরা
ব্রুনফেলসিয়া
জবা
ল্যানটাা ক্যামোরা
লিমোনিয়া স্মেকটাবিলিস্
কামিনী
কবরী
আ্যালামন্ডা ক্যাথাটিকা
জ্যাট্রোফা হেলিলিভুস

পাঁচ বাছরের বেশি বাঁচা স্থায়ী স্বাভাবের গাছ-
বেল,জুঁই,বোগেনভিলা,গোলাপ,জবা, কবরী, গন্ধরাজ, কাঞ্চন, কুন্দ,চাঁপা,মুসেন্ডা, লিমোনিয়া,কামিনী, অ্যালামন্ড, স্থলপদ্ম, ডামবিয়া, পোর্টল্যান্ডিয়া, ব্রুনফেলসিয়া,ক্যামেলিয়া,টগর এসব।

টবের প্রকার ও প্রস্ততি ঃ
বীজ বুনে চারা উৎপাদনের জন্য চওড়া ও অগভীর টব। মৌসুমী ফুলের জন্য মাঝারী আকৃতির এবং বর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী ও ঝোপ জাতীয় গাছের জন্য বড় আকারের টব প্রয়েজন। মাটির তৈরি কাঠ,কংক্রিট, সিরামিক এবং প্লাস্টিকের তৈরি টব ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্লাস্টিক টব ওজনে হালকা হওয়ায় এটি অনেকই ঝুলানো টব হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এখনও মািিটর টবই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। কাঠ ও ধাতুর তৈরি টবের দাম বেশি হওয়ায় এর ব্যবহার সীমিত। মাটির টব ভেংগে যায় এবং কাঠের টব পচনশীল বলে কংক্রিটের টব ব্যবহার করা লাভ জনক কারণ দীর্ঘদিন টেকে।

পানি চুয়ানোর জন্য টবেব নিচে ২/১ টি ছিদ্র থাকা প্রয়োজন। তবে জলজ উদ্ভিদের জন্য ব্যবহৃত টবে ছিদ্র না থাকাই ভাল। প্রতি ক্ষেত্রেই ছিদ্রযুক্ত টবেব নিচে ভাঙ্গা চাড়া, নারিকেলের ছোবড়া, খড়কুটা বা ইটের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে তার উপর কিছু শুকনো পাতা দিতে হবে। এরপর বেলে মাটি এবং তার উপর সার মাটি দিয়ে টব এমনভাবে ভর্তি করে দিতে হবে যেন ওপরে অন্তত এক ইঞ্চি পরিমাণ খালি থাকে। নতুন কিংবা পুরাতন উভয় প্রকার টবই ব্যবহারের আগে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয।

টবের মাটি কেমন হবেঃ
টবে ভাল ফুলগাছ করার জন্য চাই ভাল মাটি। সাধারণভাবে ভাল মাটি বলতে দোঁআশ মাটিকেই বোঝায়। মাটি সংগ্রহের আদর্শ জায়গা হাচ্ছ- অনাবাদি মাঠ, ক্ষেতের মাটি, পুকুর ও নদীর পাড়। সর্বদাই মাটি নিতে হবে উপর থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত। গভীর গর্তের মাটি, পাতকুয়া খোড়া মাটি, পুকুরের তলার পাঁকমাটি, গাছ বসানোর জন্য ভাল নয়। কারণ বেশি নিচের (গভীর জায়গা) মাটি প্রকৃতিতে কঠিন ও গুণে অসার হয়। উপরকার মাটিতে নানান জৈবিক পদার্থ পচে মিশে থাকে। রৌদ্রকিরণ ও হাওয়া লেগে মাটি ছত্রাক রোগ মুক্ত থাকে। এই সবের জন্যই উপরকার মাটি ভাল। নিচের মাটিতে এই সব সার পদার্থ অধিক পরিমাণে প্রবেশ করতে পারে না।
রোদ হাওয়া না লাগার জন্য নিচের মাটি আঠালো ধরনের হয়। যে সমস্ত জায়গার মাটি টবে ফুল চাষের জন্য ভাল নয় তা হাচ্ছে- নর্দমার মাটি, সারা বছর পানি জমে থাকে এমন জায়গার মাটি ও কারখানার আবর্জনা ফেলা হয় এমন জায়গার মাটি। নর্দমার মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত আবর্জনা ও গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক দ্রব্যের পরিমাণ বেশি থাকে। পানি জমে থাকা জায়গার মাটি সহজে শুকোয় না আর ছত্রাক জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব সহজে হয়। কারখানার ময়লা ফেলা জমির মাটিতে সব সময় না হলেও কোন কোনো সময় গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যকণা মিশে থাকে যা গাছের পক্ষে ক্ষতিকর।

টবের মাটি তৈরি ঃ
মাটিকে ভাল করে রোদে শুকিয়ে দশ ইঞ্চি মাপের একশো টব মাটির সঙ্গে পাঁচশো গ্রাম গুঁড়ো চুন মিশিয়ে দশ দিন বাদে চার ভাগের এক ভাগ গোবর সার, পাতা পচা সার বা কম্পোস্ট সারের যে কোনও একটি ও পাঁচ কেজি হাড়ের গুঁড়ো, পাঁচ কেজি শিং-এর গুঁড়ো, এক টব মতো কাঠ ও ঘুঁটে পোড়া ছাই মিশিয়ে দু‘ মাসের বেশি সময় কোন উম্মুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে সমস্ত জিনিসগুলি মাটির সঙ্গে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। বেশি বৃষ্টির সময় আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। হাড়ের গুঁড়ো, শিং-এর গুঁড়ো ইত্যাদি জৈবিক সার ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশতে অনেক সময় লাগে। সদ্য সার মেশানো মাটিতে গাছ বসালে সারের উপকারিতা কম পাওয়া যায় ও অনেক সময় সারের পচনক্রিয়া শুরু হওয়ার ফলে মাটির মধ্যে যে উত্তাপের সৃষ্টি হয় তাতে গাছ মরেও যেতে পারে। মাটি আগে থেকে তৈরি করার আর একটি ভাল দিক হচ্ছে সার পচার সময় যে গরম ভাবের সৃষ্টি হয তার অস্তিত্ব মাটিতে থাকে না। ফলে বসানোর সময় থেকেই গাছ সার গ্রহণে সক্ষম হয়। এই নিয়মে মাটি তৈরি করা হলে কয়েক রকম গাছ ছাড়া প্রায় সব জাতীয় গাছই ভাল হবে।

টবে লাগানোর সময় ঃ
চারা যখন বেশ বৃদ্ধি অবস্থায় থাকে তখনই ওটাকে টবে স্থানান্তর করার উপযুক্ত সময়। বর্ষার শুরু একাজের জন্য বেশ উপযোগী। যে সমস্ত ফুলগাছ শীতকালেই দেখা যায় সে গুলোর চারা নভেম্বর মাসের দিকে টবে রোপণ করতে হবে।

টব থেকে চারা খোলা ঃ
আমরা নার্সারী থেকে যে ফুলের চারা সংগ্রহ করি তা আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিথিন ব্যাগে উৎপাদন করা হতো কিন্তু বর্তমানে পলিথিন নিষিদ্ধ হওযার পর এ চারাগুলো বিভিন্ন আকারের টবে উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে চারা কেনার সময় টবে তৈরি চারা কেনাই ভাল। টবে তৈরি ফুলের চারা কেনার পর ছোট টব থেকে বড় টবে পাল্টে লাগাতে হয়। এ কাজটি সঠিকভাবে জানা না থাকার জন্য অনেকেই টবটি ভেংগে চারা গাছ বের করেন। এতে যে কেবল টবটিই নষ্ট হলো তাই নয়, অনেকেক্ষেত্রে চারা গাছটিতেও আঘাত লাগে। এসব প্রতিকুলতা কাটানোর জন্য অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে টব থেকে চারা গাছ খোলার কৌশলটি জেনে রাখা দরকার।
টব থেকে গাছ তুলে ফেলার কয়েক ঘন্টা আগে মাটিতে এমন পরিমাণ পানি দিতে হবে যাতে গাছ তোলার সময় মাটি ভেজা ভেজা থাকে। এরপর টবসহ গাছটি উল্টো করে ধরে কোন শক্ত জায়গার কোণে ঘুরিয়ে টবের কানা ঠুকতে থাকলে দেখা যাবে যে মাটিসহ চারাটি আলগা হয়ে গেছে। গাছের মাটিসহ বল যে রকম আছে তার কোনরূপ পরিবর্তন না করে অন্য টবে বা গর্ত করে মাটিতে লাগাতে হবে।

টবে চারা রোপণঃ
এক মাস বয়সের ফুলের চারা বীজতলা থেকে অথবা ছোট টব থেকে স্থানান্তর করে বড় টবে রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় চারাগাছের শিকড় চারদিকে প্রসারিত করে আলতোভাবে টব ভর্তি করে দিতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে মাটি শক্ত করে দিতে হবে, যাতে চারাগাছ হেলে না পড়ে বরং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আচ্ছাদন দেয়া ঃ
সদ্য লাগানো ফুলের চারা কয়েকদিন ছায়ায় রেখে সহনশীল করে নিতে হয়। যদি সম্ভব না হয় তাহলে কলা বা সুপারী গাছের খোল কেটে অথবা অন্য উপায়ে চারাগুলো রৌদ্র থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ অবস্থায় সকালে-বিকালের রোদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছের গোড়া খুঁচিয়ে দেওয়াঃ টবে গাছের গোড়ার মাটি একেবারে গুড়ো না করে চাকা চাকা করে খুঁচে দেয়াই ভাল। এক্ষেত্রে মাটি খোঁচানোর গভীরতা হবে ৩-১০ সেঃ মিঃ বা ১ থেকে ৪ ইঞ্চি গভীর। এ কাজটি প্রতি ১০ দিনে একবার করে করতে হবে।

মালচিং ঃ
গ্রীস্মকালে গাছের গোড়ায় আলতোভাবে,কাটা খড়, ছাঁটা ঘাস ,শুকনো পাতা বা পাতা পচা সার দিয়ে ঢেকে আর্দ্রতা ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে অনেক দিন ধরে মাটিতে রস সংরক্ষিত থাকে। তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টির প্রতি নজর রাখতে হবে সেটি হল আস্তরনের উপকরণ যেন পরিস্কার পরিচছন্ন হয়। অন্যথায় রোগ ও পোকার আক্রমন বাড়বে। গরমের দিনেই রস ধরে রাখার জন্য মালচিং-এর প্রয়োজন হয়।

গাছের অবলম্বন ও গাছ বাঁধাঃ
গাছকে খাড়া রাখার জন্য অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। গাছের চারা অবস্থা থেকেই এ ব্যবস্থা করতে হয়। এ কাজে বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হয়। এতে বারবার কঞ্চি ওঠানো বসানোর ফলে গাছ ও শিকড়ের ক্ষতি হতে পারে। তাই চারা অবস্থাতেই এমন অবলম্বন লাগাতে হবে যা আর পল্টানোর প্রয়োজন হবে না। কঞ্চিটিকে গাছের সংগে মিলিয়ে রঙ দিয়ে দিলে আরো ভাল দেখাবে। গাছকে অবলম্বনের সংগে এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে গাছের কোন ক্ষতি না হয়। একটি মোলায়েম দড়ি দিয়ে প্রথমে একদিক অবলম্বনের সংগে বেঁধে অপরদিকে বাংলা ৪ এর মত করে গাছের সংগে আলতোভাবে ঘুরিয়ে বাঁধতে হবে যাতে গাছটি বাতাসে সামান্য নড়তে পারে।

টবে পানি সেচঃ
টবে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দেওয়া ভাল। মাটিতে রস কম থাকলে গাছ বাড়ে না। আবার অতিরিক্ত পানিতে গাছের শিকড় ও গোড়া পচে যায়। চারাগাছ লাগানোর পর পানির অভাবে টবের গাছ শুকিয়ে যায়, তবে বেশি পানি হলে গাছ পচে যেতে পারে।চারা লাগানোর পর এমন পরিমান সেচ দিতে হবে যেন টবের মাটি সাতদিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। পানি সেচের জন্য বিকেল বেলাই ভাল। জৈব কিংবা রাসায়নিক সার প্রয়োগের পর এমন পরিমাণ সেচ দিতে হবে যাতে মাটি তিন দিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। বর্ষাকালে টব স্যাঁতসেঁতে মাটির উপরে রাখলে তলার ছিদ্র দিয়ে ঠিকমত পানি নিস্কাশন নাও হতে পারে। এজন্য এ সময়ে ৩-৪ ইঞ্চি ফাঁক করে ইট স্থাপন করে তার উপর টব রাখা যেতে পারে।

উপরি সার প্রয়োগ ঃ
টবের মাটি ও খাদ্যোপাদান সীমিত বলে সব টবের গাছেই উপরি সার দেয়ার দরকার হয়। এই উপরি সার টবের চারিদিকে কানা ঘেষে ৬ সেঃ মিঃ গভীর ও ৩ সেঃ মিঃ চওড়া করে মাটি খুঁড়ে সমান হারে দিয়ে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

গাছ লাগানোর পর থেকে খৈল,মাছ গোবর ইত্যাদি পচা আধা লিটার পানি চার লিটার পানির সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে আধা লিটার করে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দিতে হবে।

তরল সার ব্যবহারের সময় গাছের গোড়ার মাটি বেশ ভেজা ভেজা থাকা দরকার। তাই এ সার ব্যবহারের কয়েক ঘন্টা আগে গাছে একবার সেচ দিয়ে নিতে হয। তরল সার দেয়ার পরও একবার
সেচ দিলে ভাল হয়।

কুঁড়ি আসার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ৫০ গ্রাম টিএসপি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২৫ গ্রাম এমপি এক সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে তিন গ্রাম করে সাত দিন অন্তর দিতে হবে। এই রাসায়নিক সার তিন বারের বেশি দেবার দরকার নেই। তবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সার কোন ক্রমেই শিকড়ের উপর না পড়ে।

বেশি দিন ধরে ফুল ফুটানো ঃ
তুলনামূলকভাবে বেশি দিন ধরে ফুল ফোটাতে চাইলে গাছে কখনও ফুল শুকাতে দিতে নেই। ফুল শুকানো শুরু হলেই ফুল কেটে দিতে হয়। এতে ভাল ফুল পাওয়া যায়।

বালাইব্যবস্থাপনাঃ
আগে যারা টবে ফুল চাষ করতেন তারা সব সময়ই রোগ পোকার আক্রমনের ভয়ে ভীতর থাকতেন। তীরে এসে তরী ডোবার মতো তৈরি টবের গাছ পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেও নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আগেকার অবস্থা আর নেই। বর্তমানে যে কোন ধরনের রোগ-পোকা দমনে সক্ষম বহু ওষুধ আবিস্কৃত হয়েছে, যা সহজেই পাওয়া যায়। সাধারনত উদ্ভিদ শ্রেণীর পঁচানব্বই ভাগের মৃত্যু দু‘ ভাবে হয়। ছত্রাক রোগ ও পোকার আক্রমন।

ছত্রাক রোগ হয় সূর্যের আলো কম পড়া, স্যাঁতসেতে মাটি, পানি জমা জায়গার মাটি ও বহুদিন ভিজে অবস্থায় থাকা জৈবিক সার মেশানো মাটির সাহায্যে গাছ লাগানো হলে। যে সকল নিয়মগুলো পালন করলে ছাত্রাক রোগ কিছুটা বিনা ওষুধে প্রতিরোধ করা যায় সেগুলো হল টবের জন্য যে মাটি ব্যবহার করা হবে তা ভাল করে রোদে শুকানো, ঁিনচু জায়গার মাটি টবের জন্য ব্যবহার না করা, ড্যাম্প ধরা জায়গায় থেকে জৈবিক পদার্থ সংগ্রহ করে তা ভালভাবে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করা।

টবে ফুল গাছের বিভিন্ন ধরনের রোগ দমনের জন্য নানান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রস্তুত করে থাকেন। একই গুণাগুণ সম্পন্ন ওষুধের আলাদা প্রতিষ্ঠানের আলাদা নাম। আর প্রত্যেকটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রয়োগপদ্ধতি, ওষুধের পরিমাণ সম্বন্ধে জানিয়ে থাকেন। টবের জন্য পরিমাপ নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে। টবের ফুল গাছের জন্য ছত্রাক রোগ মুক্তির সহায়ক কয়েকটি ওষুধের নাম, পরিমাপ ও প্রয়োগ পদ্ধতির বিষয় উল্লেখ করা হল যা ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া গেছে।

ছত্রাক রোগের ওষুধ প্রয়োগ করার প্রথমে রোগের সম্ভব্য লক্ষণগুলি জানা আবশ্যক। মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ সার থাকা সত্বেও গাছ নিস্তেজ ও পাতার রং সবুজের পরিবর্তে হলুদাভ, পোকার অনুপস্থিতি সত্বেও গাছ মরে গেলে, বুঝতে হবে শেকড়ে ছত্রাক রোগ আক্রমণের জন্য হচ্ছে। অনেক সময় ছত্রাকের আক্রমণে ছাল উঠে কান্ডে নানাভাবে দাগ পড়ে এবং ধীরে ধীরে ডালগুলো শুকিয়ে যায় ।

কাটিং করার সময় হঠাৎ ডালগুলি নিস্তেজ হয়ে মরে যেতে থাকলে ডালগুলিকে ও চারা তৈরির মাধ্যমকে ছত্রাক রোগ মুক্ত করে নিতে হবে। অনেক সময় ছত্রাক রোগসহ ড্যাম্প ধরা পাতা পচা সার বা গোবর সার ব্যবহার করলে শেকড় নষ্ট হয়ে গাছ সতেজ হয় না ও পাতায় কালো কালো দাগ পড়ে। এ সমস্ত ছত্রাকজনিত রোগ দমন অথবা এর থেকে রেহাই পেতে হলে ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানির সাথে দু‘ গ্রাম হারে মিশিয়ে হ্যান্ড ¯েপ্রয়ারের সাহায্যে যতগুলি সম্ভব গাছকে সম্পূর্নরুপে ভিজিয়ে দিতে হবে। এ কাজটি করতে হবে প্রথমে ১৫ দিন অন্তর পরে মাসে একবার।
গাছ কম বেশি হলে কম বেশি পরিমাণ ওষুধ নিতে হবে। ব্যাভিস্টিন ছাড়া কপার অক্সিক্লোরাইড প্রতি লিটার পানিতে চার গ্রাম হিসেবে গুলে একই নিয়মে দিতে হবে ।

অথবা ডায়াথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে গুলে একইভাবে দিতে হবে। এছাড়া আরও কয়েক রকমের ছত্রাকনাশক থাকলেও কার্যকারিতা প্রায় সবেরই একই রকম। উল্লেখিত ওষুধের যে কোন একটি ব্যবহারেই সুফল পাওয়া যাবে।

গাছে পোকা লাগলে অতি সহজেই তা বোঝা যায়। পোকায় পাতা খেয়ে নেয়। কখনও পাতার তলার সবুজ অংশ খেয়ে নেবার ফলে পাতায় সাদা দাগ পড়ে, পাতা শুকিয়ে ঝরে যায়। টবের উপর মল পড়ে থাকা দেখে সহজেই শুঁয়ো জাতীয় পোকা ধরেছে বোঝা যায়। এফিডের বাসা সাদা তুলোর টুকরোর মতো ডালে জড়িয়ে থাকে। কয়েকরকম পোকা ডাল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে গাছ মেরে ফেলে।

মাইটস দ্বারা চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,গাঁদ প্রভূতি গাছ খুব বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়। অন্যান্য গাছের তুলনায় এই মাকড় পাতার রস চুসে খেয়ে নেবার পর পাতার তলায় সাদা সাদা দাগ পড়ে শুকিয়ে যায়। মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ জাল গাছে দেখা যায়।এই মাকড় দমনের জন্য শতকরা ৮০ ভাগ সালফার জাতীয় ওষুধ যেমন থিওভিট প্রতি লিটারে ২ গ্রাম হিসেবে ¯েপ্র করতে হবে। এ কাজটি ১৫ দিন অন্তর করলে গাছের মাকড়ের আক্রমন কমে যাবে। ডালে তুলোর মতো পোকার বাসা থাকলে ম্যালাথিয়ন কুড়ি ফোঁটা এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার দিলেই সব পোকা মরে যাবে। শুঁয়োপোকা বা পাতা খেয়ে নেয়া এমন পোকা মারতে ম্যালাথিয়ন ব্যবহার করা যাবে। ডাল ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে গাছ নষ্ট যাতে না করতে পারে তার জন্য সুমিসিডিন বা রিপকর্ড নামক ওষুধের দশ ফোটা এক লিটার পানিতে গুলে সপ্তাহে একবার গাছে দিতে হবে। এ ছাড়া টবে গাছ বসানোর সময় প্রতি টবে চা চামচের চার ভাগের একভাগ ফুরাডানের দানা ছড়িয়ে দেওয়া সব থেকে নিরাপদ। ছত্রাক বা পোকা গাছের বৃদ্ধি, সৌন্দর্য ও বাঁচার পক্ষে ক্ষতিকারক। এই জন্য প্রথম থেকেই গাছ লাগালোর পরিবেশ হওয়া উচিত আলো বাতাসযুক্ত পরিস্কার, সম্ভব হলে গাছ লাগালোর সময়ই গাছকে ছত্রাক নিবারক করার ওষুধে ধুয়ে নিতে হবে। লাগানোর পর নিয়মিত ১৫ দিন অন্তর পোকা মারার ওষুধ দিতে হবে। প্রথম অবস্থাতেই কাজগুলি করা সহজ। এতে গাছও সুন্দর সজীব থাকে। অবহেলার কারনে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হওয়া গাছকে রোগ মুক্ত করা মোটেই সহজ কাজ নয়।

সহায়িকাঃ
১. ফুল পাতা বনসাই, জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়, আনান্দ পাবলিসার্স প্রাইভেট লিমিেিটড, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৭০০০০৯. পাতা ১১-২৬।
২. টবে ও আঙ্গিনায় ফুলের বাগান, কৃষিবিদ দীলিপ কুমার চক্রবর্তী, কৃষিবিদ আবুল কালাম,কৃষি লেখক ফোরাম, খামারবাড়ি ফার্মগেট ঢাকা-১২১৫। পাতা ৩২-৩৪।
৩. উদ্ভিদের ব্যাধি, এস কে চক্রবর্তী, ভারতী বুক স্টল, ৬ বি রমনাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলকাতা-৯ পাতা ২১০-২২৮।
৪. অন্নদাতা, ই টি ভি বাংলা।

আপনার মুল্যবান কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল সংরক্ষণ করুন এবং অন্যান্য তথ্য দিন

জনপ্রিয় পোস্ট
https://www.youtube.com/watch?v=wRt0Eo1voJ4

শহিদ শেখ রাসেলের সমাধিতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের শ্রদ্ধা নিবেদন

টবে ফুল চাষ

সময় : ১০:১৬:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ মে ২০২২

আমরা সকলেই সুন্দরের পুজারী। আর এ পৃথিবিতে ফুলের মত সুন্দর আর পবিত্র কোন কিছু নেই। তাইতো যুগে যুগে মানুষের কাছে ফুল সমাদ্রিত। এ পৃথিবী যা কিছু সুন্দর তার সমস্তটাই ফুলের সাথে তুলনীয়। আর তাইতো সাহিত্যের সর্বত্র ফুলের বিচরণ। পৃথিবীতে এমন মানুষ নেই যিনি ফুল পছন্দ করেন না। ফুল কেবল আনন্দই দেয় না শোভা বর্ধনের ক্ষেত্রেও এক গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে ফুলের ব্যবহার ও চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফুলের রূপ লাবন্য ও সৌরভ চোখের ও মনের পিপাসা মেটায়। তাই প্রাগ ঐতিহাসিক যুগথেকে ফুল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিগনিত। ফুলের সৌরভ এক দিকে যেমন মানুষকে বিমোহিত করে তেমনি এর সোন্দর্য বাড়ির পরিবেশকে করে তোলে আকর্ষণীয়। আর এতে বাড়ির মালিকের রুচি বোধেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। একবিংশ শতাব্দির কর্ম ব্যস্ত মানুষের কর্মময় জীবনের কঠিন ও ব্যস্ততম পরিবেশ থেকে বাড়ি ফিরে ফুলের পরশে মানুষ খুঁজে পায় এক অনাবিল আনন্দ ও মানসিক প্রশান্তি। এছাড়াও মনের যত দুঃখ, যাতনা, গ্নানি, অবসন্নতা নিমেষেই দূর করতে সাহায্য করে। নিজ হাতে উৎপাদিত ফুলের বৈচিত্র পারিবারিক আনন্দ বাড়িয়ে দেয়।

বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমরা যারা শহরে বাস করি তারা প্রশস্ত উঠোন আছে এমন বাড়ি ছেড়ে ফ্লাটে বসবাস করছি অথবা করার চিন্তা ভাবনা করছি। এর ফলে যে ঘটনাটি ঘটছে সেটি হল ফুল বাগান করার মত আর আমরা জায়গা পাচ্ছিনা। এতে যে একবিংশ শতাব্দিতে এসে মানুষ তার সৌন্দর্য বিকাশের পথটি হারিয়ে ফেলবে এমনটি ভাবার কোন অবকাশ নেই। তার কারন সভ্য সমাজের মানুষের মত ফুলও তার আদি বাসস্থান বাগান ছেড়ে জায়গা করে নিয়েছে রকমারি টবে। তবে টবে জায়গা করে নেয়ার ফলে যে লাভটি হয়েছে সেটি হল তার বিচরণ ক্ষেত্রে এবং যত্ন বেড়ে গিয়েছে। মানুষ এখন টবে ফুল গাছ লাগিয়ে খুব সহজেই তার মানসিক আত্ম তৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারছে। শুধু তাই নয় এর ফলে ফুল গাছ এ দেশের বেকার সমস্যা সমাধানেও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। ধনী সমাজে টবে ফুলের চাষ এখন একটি ফ্যাশানে পরিনত হয়েছে। তবে আমরা যা কিছুই বলি না কেন বর্তমানে টবে ফুল চাষের প্রতি মানুষের আগ্রহ যে দিন দিন বাড়ছে তা হলফ করে বলা যায়। আবার অনেকের টবে ফুল চাষের প্রাথমিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে চাষের ক্ষেত্রে কোন না কোন সমস্যায় পড়েছেন। আর এই তিক্ত অভিজ্ঞতা পুনরায় তাকে ফুল চাষে আকৃষ্ট করে না। তারপরেও কারো না কারো সাহায্য নিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছে অনেকেই। সৌন্দর্যপ্রিয় মানুষ বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে টবে ফুলের চাষকে স্বার্থক ও সুন্দর করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কথা উল্লেখ করতে পারি। তবে যাই হোক কোন কাজ করার আগে আমাদের হাতে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনের একটি গাইড থাকে তবে কাজের সফলতার সম্ভবনার পাল্লা ভারি হয়ে যায়। সে রকমই একটি গাইড হিসেবে টবে ফুলের চাষ সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা হল।

টবে ফুল চাষের পূর্ব প্রস্তুতিঃ
গাছ বসানোর সফলতা নির্ভর করে সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বসানোর মাধ্যমে। কোন কিছু না ভেবে কাজ শুরু করার ফল অনেক সময় ভালোর চেয়ে মন্দই হয় বেশি। এই ধরনের অসফলতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে আর্থিক, শারীরিক ও পরিবেশগত সুবিধা অসুবিধার কথা ভেবে টবে ফুলের চাষ শুরু করা। সব রকমের ফুলগাছ সকলের ভাল না লাগালেও গাছ বসানোর প্রয়োজনীয় জিনিস প্রায় সব গাছের জন্য একই হবে। প্রথমে চাই ভালো দোঁআশ মাটি, টব, পানি দেয়ার জন্য ঝাঝরি। নানা ধরনের পোকার আক্রমণে ফুলগাছ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তার জন্য পোকা মারা ওষুধ। ঠিকমতো ওষুধ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন হ্যান্ড ¯েপ্রয়ার। গাছের ডাল ছাঁটাইয়ের জন্য সিকেচার বা কাঁচি এবং মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি। আর চাই গাছ বাঁধার পাটের সুতো, বাঁশের কাঠি। জৈবিক সার পচানোর জন্য মাটির গামলা, প্লাস্টিক বালতি, মগ ইত্যাদি। এই সমস্ত জিনিসগুলি সংগ্রহ করে রাখার প্রধান সুবিধা হচ্ছে দরকার পড়ার সাথে সাথে তা কাজে লাগানো যাবে।
না হলে গাছ আনার পর দেখা যাবে বসাবার টব নেই অথবা পোকার আক্রমণে গাছ শেষ হতে চলেছে কিন্তু পোকার আক্রমণ রোধ করার মতো কোন ওষুধ কাছে নেই। এ ছাড়াও টুকিটাকি অনেক কিছুর প্রয়োজন হবে এবং সেগুলি আস্তে আস্তে জোগাড় করে নিতে হবে। মূল কিছু উপকরণ আগের থেকে সংগ্রহ করে রাখাই ভাল।

কোন ফুল কখন লাগাবেনঃ
বিশাল উদ্ভিদ সাম্রাজ্যের সব কিছুই আপন নিয়মে চলে। নিয়মের ব্যতিক্রম বড় একটা দেখা যায় না। শরতের আগমন বার্তা ঘোষনাকারী কাশ ফুল শীতে ফোটে না। শীতের চন্দ্রমল্লিকা গরমে হয় না। ফুল, পাতাবাহারের নির্দিষ্ট আবহাওয়া প্রিয়তা থাকার ফলে ঋতু অনুসারে গাছের ফুল ফোটে। যে কোন ধরনের গাছ লাগিয়ে সফলতা পেতে হলে গাছগুলির বৃদ্ধি ও ফুল হওয়ার যথাযথ সময় জেনে রাখা উচিত। চারা লাগানো ও ফুল ফোটার প্রয়োজনীয় সময় সূচি নিচে দেওয়া হল। এই সাধারণ সময় সুচি কোনও প্রদর্শনীভিত্তিক নয়।

প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে গাছ করার সময় প্রদর্শনীর নির্ধারিত দিনের সঙ্গে নির্বাচিত গাছের প্রয়োজনীয় সময়ের হিসাব করে নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা, বাগানের মাটিতে লাগানো গাছের ফুল ফোটার সময় টবের গাছের চেয়ে দশ-বারো দিন সময় বেশি লাগবে।

শীত কালীন ফুল
ক্যামেলিয়া
পয়েনসেটিয়া
বোগেনভিলা
ডালিয়া(ম)
চন্দ্রমল্লিকা(ম)
কারনেশন(ম)
হলিহক(ম)
পিটুনিয়া(ম)
স্যালভিয়া(ম)
গোলাপ
জারবেরা
গাজানিয়া

গ্রীষ্ম কালীন ফুল

গন্ধরাজ
রজনীগন্ধা
জারবেরা
গাজানিয়া (ম)
সূর্যমুখী (ম)
জিনিয়া(ছোট) (ম)
পিটুনিয়া(ছোট) (ম)
সিলোসিয়া(ম)
বোগেনভিলা
“ম” চিহ্নটি একান্তভাবে মৌসুমী।

বর্ষা কালীন ফুল
বেল-সব ভ্যারাইটি
জুঁই- সব ভ্যারাইটি
চাঁপা- সব ভ্যারাইটি
মুসেন্ডা- সব ভ্যারাইটি
পোর্টল্যানডিয়া
দোপাটি
জিনিয়া ডবল
সুর্যমুখী (ছোট)
স্থল পদ্ম
হাইড্রানজিয়া

প্রায় সারা বৎসর ফুল হয়

কাঞ্চন (সাদা)
ধুতুরা
ব্রুনফেলসিয়া
জবা
ল্যানটাা ক্যামোরা
লিমোনিয়া স্মেকটাবিলিস্
কামিনী
কবরী
আ্যালামন্ডা ক্যাথাটিকা
জ্যাট্রোফা হেলিলিভুস

পাঁচ বাছরের বেশি বাঁচা স্থায়ী স্বাভাবের গাছ-
বেল,জুঁই,বোগেনভিলা,গোলাপ,জবা, কবরী, গন্ধরাজ, কাঞ্চন, কুন্দ,চাঁপা,মুসেন্ডা, লিমোনিয়া,কামিনী, অ্যালামন্ড, স্থলপদ্ম, ডামবিয়া, পোর্টল্যান্ডিয়া, ব্রুনফেলসিয়া,ক্যামেলিয়া,টগর এসব।

টবের প্রকার ও প্রস্ততি ঃ
বীজ বুনে চারা উৎপাদনের জন্য চওড়া ও অগভীর টব। মৌসুমী ফুলের জন্য মাঝারী আকৃতির এবং বর্ষজীবী, বহুবর্ষজীবী ও ঝোপ জাতীয় গাছের জন্য বড় আকারের টব প্রয়েজন। মাটির তৈরি কাঠ,কংক্রিট, সিরামিক এবং প্লাস্টিকের তৈরি টব ব্যবহার করা যেতে পারে।
প্লাস্টিক টব ওজনে হালকা হওয়ায় এটি অনেকই ঝুলানো টব হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তবে আমাদের দেশে এখনও মািিটর টবই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। কাঠ ও ধাতুর তৈরি টবের দাম বেশি হওয়ায় এর ব্যবহার সীমিত। মাটির টব ভেংগে যায় এবং কাঠের টব পচনশীল বলে কংক্রিটের টব ব্যবহার করা লাভ জনক কারণ দীর্ঘদিন টেকে।

পানি চুয়ানোর জন্য টবেব নিচে ২/১ টি ছিদ্র থাকা প্রয়োজন। তবে জলজ উদ্ভিদের জন্য ব্যবহৃত টবে ছিদ্র না থাকাই ভাল। প্রতি ক্ষেত্রেই ছিদ্রযুক্ত টবেব নিচে ভাঙ্গা চাড়া, নারিকেলের ছোবড়া, খড়কুটা বা ইটের টুকরো দিয়ে বন্ধ করে তার উপর কিছু শুকনো পাতা দিতে হবে। এরপর বেলে মাটি এবং তার উপর সার মাটি দিয়ে টব এমনভাবে ভর্তি করে দিতে হবে যেন ওপরে অন্তত এক ইঞ্চি পরিমাণ খালি থাকে। নতুন কিংবা পুরাতন উভয় প্রকার টবই ব্যবহারের আগে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয।

টবের মাটি কেমন হবেঃ
টবে ভাল ফুলগাছ করার জন্য চাই ভাল মাটি। সাধারণভাবে ভাল মাটি বলতে দোঁআশ মাটিকেই বোঝায়। মাটি সংগ্রহের আদর্শ জায়গা হাচ্ছ- অনাবাদি মাঠ, ক্ষেতের মাটি, পুকুর ও নদীর পাড়। সর্বদাই মাটি নিতে হবে উপর থেকে দেড় ফুট গভীরতা পর্যন্ত। গভীর গর্তের মাটি, পাতকুয়া খোড়া মাটি, পুকুরের তলার পাঁকমাটি, গাছ বসানোর জন্য ভাল নয়। কারণ বেশি নিচের (গভীর জায়গা) মাটি প্রকৃতিতে কঠিন ও গুণে অসার হয়। উপরকার মাটিতে নানান জৈবিক পদার্থ পচে মিশে থাকে। রৌদ্রকিরণ ও হাওয়া লেগে মাটি ছত্রাক রোগ মুক্ত থাকে। এই সবের জন্যই উপরকার মাটি ভাল। নিচের মাটিতে এই সব সার পদার্থ অধিক পরিমাণে প্রবেশ করতে পারে না।
রোদ হাওয়া না লাগার জন্য নিচের মাটি আঠালো ধরনের হয়। যে সমস্ত জায়গার মাটি টবে ফুল চাষের জন্য ভাল নয় তা হাচ্ছে- নর্দমার মাটি, সারা বছর পানি জমে থাকে এমন জায়গার মাটি ও কারখানার আবর্জনা ফেলা হয় এমন জায়গার মাটি। নর্দমার মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত আবর্জনা ও গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক দ্রব্যের পরিমাণ বেশি থাকে। পানি জমে থাকা জায়গার মাটি সহজে শুকোয় না আর ছত্রাক জাতীয় রোগের প্রাদুর্ভাব সহজে হয়। কারখানার ময়লা ফেলা জমির মাটিতে সব সময় না হলেও কোন কোনো সময় গাছের পক্ষে ক্ষতিকারক বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্যকণা মিশে থাকে যা গাছের পক্ষে ক্ষতিকর।

টবের মাটি তৈরি ঃ
মাটিকে ভাল করে রোদে শুকিয়ে দশ ইঞ্চি মাপের একশো টব মাটির সঙ্গে পাঁচশো গ্রাম গুঁড়ো চুন মিশিয়ে দশ দিন বাদে চার ভাগের এক ভাগ গোবর সার, পাতা পচা সার বা কম্পোস্ট সারের যে কোনও একটি ও পাঁচ কেজি হাড়ের গুঁড়ো, পাঁচ কেজি শিং-এর গুঁড়ো, এক টব মতো কাঠ ও ঘুঁটে পোড়া ছাই মিশিয়ে দু‘ মাসের বেশি সময় কোন উম্মুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে সমস্ত জিনিসগুলি মাটির সঙ্গে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করবে। বেশি বৃষ্টির সময় আচ্ছাদন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। হাড়ের গুঁড়ো, শিং-এর গুঁড়ো ইত্যাদি জৈবিক সার ভালভাবে মাটির সঙ্গে মিশতে অনেক সময় লাগে। সদ্য সার মেশানো মাটিতে গাছ বসালে সারের উপকারিতা কম পাওয়া যায় ও অনেক সময় সারের পচনক্রিয়া শুরু হওয়ার ফলে মাটির মধ্যে যে উত্তাপের সৃষ্টি হয় তাতে গাছ মরেও যেতে পারে। মাটি আগে থেকে তৈরি করার আর একটি ভাল দিক হচ্ছে সার পচার সময় যে গরম ভাবের সৃষ্টি হয তার অস্তিত্ব মাটিতে থাকে না। ফলে বসানোর সময় থেকেই গাছ সার গ্রহণে সক্ষম হয়। এই নিয়মে মাটি তৈরি করা হলে কয়েক রকম গাছ ছাড়া প্রায় সব জাতীয় গাছই ভাল হবে।

টবে লাগানোর সময় ঃ
চারা যখন বেশ বৃদ্ধি অবস্থায় থাকে তখনই ওটাকে টবে স্থানান্তর করার উপযুক্ত সময়। বর্ষার শুরু একাজের জন্য বেশ উপযোগী। যে সমস্ত ফুলগাছ শীতকালেই দেখা যায় সে গুলোর চারা নভেম্বর মাসের দিকে টবে রোপণ করতে হবে।

টব থেকে চারা খোলা ঃ
আমরা নার্সারী থেকে যে ফুলের চারা সংগ্রহ করি তা আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পলিথিন ব্যাগে উৎপাদন করা হতো কিন্তু বর্তমানে পলিথিন নিষিদ্ধ হওযার পর এ চারাগুলো বিভিন্ন আকারের টবে উৎপাদন করা হচ্ছে। তবে চারা কেনার সময় টবে তৈরি চারা কেনাই ভাল। টবে তৈরি ফুলের চারা কেনার পর ছোট টব থেকে বড় টবে পাল্টে লাগাতে হয়। এ কাজটি সঠিকভাবে জানা না থাকার জন্য অনেকেই টবটি ভেংগে চারা গাছ বের করেন। এতে যে কেবল টবটিই নষ্ট হলো তাই নয়, অনেকেক্ষেত্রে চারা গাছটিতেও আঘাত লাগে। এসব প্রতিকুলতা কাটানোর জন্য অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে টব থেকে চারা গাছ খোলার কৌশলটি জেনে রাখা দরকার।
টব থেকে গাছ তুলে ফেলার কয়েক ঘন্টা আগে মাটিতে এমন পরিমাণ পানি দিতে হবে যাতে গাছ তোলার সময় মাটি ভেজা ভেজা থাকে। এরপর টবসহ গাছটি উল্টো করে ধরে কোন শক্ত জায়গার কোণে ঘুরিয়ে টবের কানা ঠুকতে থাকলে দেখা যাবে যে মাটিসহ চারাটি আলগা হয়ে গেছে। গাছের মাটিসহ বল যে রকম আছে তার কোনরূপ পরিবর্তন না করে অন্য টবে বা গর্ত করে মাটিতে লাগাতে হবে।

টবে চারা রোপণঃ
এক মাস বয়সের ফুলের চারা বীজতলা থেকে অথবা ছোট টব থেকে স্থানান্তর করে বড় টবে রোপণ করা উচিত। রোপণের সময় চারাগাছের শিকড় চারদিকে প্রসারিত করে আলতোভাবে টব ভর্তি করে দিতে হবে। এরপর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে মাটি শক্ত করে দিতে হবে, যাতে চারাগাছ হেলে না পড়ে বরং সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আচ্ছাদন দেয়া ঃ
সদ্য লাগানো ফুলের চারা কয়েকদিন ছায়ায় রেখে সহনশীল করে নিতে হয়। যদি সম্ভব না হয় তাহলে কলা বা সুপারী গাছের খোল কেটে অথবা অন্য উপায়ে চারাগুলো রৌদ্র থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এ অবস্থায় সকালে-বিকালের রোদ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছের গোড়া খুঁচিয়ে দেওয়াঃ টবে গাছের গোড়ার মাটি একেবারে গুড়ো না করে চাকা চাকা করে খুঁচে দেয়াই ভাল। এক্ষেত্রে মাটি খোঁচানোর গভীরতা হবে ৩-১০ সেঃ মিঃ বা ১ থেকে ৪ ইঞ্চি গভীর। এ কাজটি প্রতি ১০ দিনে একবার করে করতে হবে।

মালচিং ঃ
গ্রীস্মকালে গাছের গোড়ায় আলতোভাবে,কাটা খড়, ছাঁটা ঘাস ,শুকনো পাতা বা পাতা পচা সার দিয়ে ঢেকে আর্দ্রতা ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে করে অনেক দিন ধরে মাটিতে রস সংরক্ষিত থাকে। তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টির প্রতি নজর রাখতে হবে সেটি হল আস্তরনের উপকরণ যেন পরিস্কার পরিচছন্ন হয়। অন্যথায় রোগ ও পোকার আক্রমন বাড়বে। গরমের দিনেই রস ধরে রাখার জন্য মালচিং-এর প্রয়োজন হয়।

গাছের অবলম্বন ও গাছ বাঁধাঃ
গাছকে খাড়া রাখার জন্য অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। গাছের চারা অবস্থা থেকেই এ ব্যবস্থা করতে হয়। এ কাজে বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করা হয়। এতে বারবার কঞ্চি ওঠানো বসানোর ফলে গাছ ও শিকড়ের ক্ষতি হতে পারে। তাই চারা অবস্থাতেই এমন অবলম্বন লাগাতে হবে যা আর পল্টানোর প্রয়োজন হবে না। কঞ্চিটিকে গাছের সংগে মিলিয়ে রঙ দিয়ে দিলে আরো ভাল দেখাবে। গাছকে অবলম্বনের সংগে এমনভাবে বাঁধতে হবে যাতে গাছের কোন ক্ষতি না হয়। একটি মোলায়েম দড়ি দিয়ে প্রথমে একদিক অবলম্বনের সংগে বেঁধে অপরদিকে বাংলা ৪ এর মত করে গাছের সংগে আলতোভাবে ঘুরিয়ে বাঁধতে হবে যাতে গাছটি বাতাসে সামান্য নড়তে পারে।

টবে পানি সেচঃ
টবে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দেওয়া ভাল। মাটিতে রস কম থাকলে গাছ বাড়ে না। আবার অতিরিক্ত পানিতে গাছের শিকড় ও গোড়া পচে যায়। চারাগাছ লাগানোর পর পানির অভাবে টবের গাছ শুকিয়ে যায়, তবে বেশি পানি হলে গাছ পচে যেতে পারে।চারা লাগানোর পর এমন পরিমান সেচ দিতে হবে যেন টবের মাটি সাতদিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। পানি সেচের জন্য বিকেল বেলাই ভাল। জৈব কিংবা রাসায়নিক সার প্রয়োগের পর এমন পরিমাণ সেচ দিতে হবে যাতে মাটি তিন দিন পর্যন্ত ভেজা থাকে। বর্ষাকালে টব স্যাঁতসেঁতে মাটির উপরে রাখলে তলার ছিদ্র দিয়ে ঠিকমত পানি নিস্কাশন নাও হতে পারে। এজন্য এ সময়ে ৩-৪ ইঞ্চি ফাঁক করে ইট স্থাপন করে তার উপর টব রাখা যেতে পারে।

উপরি সার প্রয়োগ ঃ
টবের মাটি ও খাদ্যোপাদান সীমিত বলে সব টবের গাছেই উপরি সার দেয়ার দরকার হয়। এই উপরি সার টবের চারিদিকে কানা ঘেষে ৬ সেঃ মিঃ গভীর ও ৩ সেঃ মিঃ চওড়া করে মাটি খুঁড়ে সমান হারে দিয়ে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

গাছ লাগানোর পর থেকে খৈল,মাছ গোবর ইত্যাদি পচা আধা লিটার পানি চার লিটার পানির সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে আধা লিটার করে প্রতি সপ্তাহে একবার করে দিতে হবে।

তরল সার ব্যবহারের সময় গাছের গোড়ার মাটি বেশ ভেজা ভেজা থাকা দরকার। তাই এ সার ব্যবহারের কয়েক ঘন্টা আগে গাছে একবার সেচ দিয়ে নিতে হয। তরল সার দেয়ার পরও একবার
সেচ দিলে ভাল হয়।

কুঁড়ি আসার লক্ষণ প্রকাশ পেলে ৫০ গ্রাম টিএসপি ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ২৫ গ্রাম এমপি এক সাথে মিশিয়ে প্রতি গাছে তিন গ্রাম করে সাত দিন অন্তর দিতে হবে। এই রাসায়নিক সার তিন বারের বেশি দেবার দরকার নেই। তবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন সার কোন ক্রমেই শিকড়ের উপর না পড়ে।

বেশি দিন ধরে ফুল ফুটানো ঃ
তুলনামূলকভাবে বেশি দিন ধরে ফুল ফোটাতে চাইলে গাছে কখনও ফুল শুকাতে দিতে নেই। ফুল শুকানো শুরু হলেই ফুল কেটে দিতে হয়। এতে ভাল ফুল পাওয়া যায়।

বালাইব্যবস্থাপনাঃ
আগে যারা টবে ফুল চাষ করতেন তারা সব সময়ই রোগ পোকার আক্রমনের ভয়ে ভীতর থাকতেন। তীরে এসে তরী ডোবার মতো তৈরি টবের গাছ পোকার আক্রমণে নষ্ট হয়ে যেতে দেখেও নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আগেকার অবস্থা আর নেই। বর্তমানে যে কোন ধরনের রোগ-পোকা দমনে সক্ষম বহু ওষুধ আবিস্কৃত হয়েছে, যা সহজেই পাওয়া যায়। সাধারনত উদ্ভিদ শ্রেণীর পঁচানব্বই ভাগের মৃত্যু দু‘ ভাবে হয়। ছত্রাক রোগ ও পোকার আক্রমন।

ছত্রাক রোগ হয় সূর্যের আলো কম পড়া, স্যাঁতসেতে মাটি, পানি জমা জায়গার মাটি ও বহুদিন ভিজে অবস্থায় থাকা জৈবিক সার মেশানো মাটির সাহায্যে গাছ লাগানো হলে। যে সকল নিয়মগুলো পালন করলে ছাত্রাক রোগ কিছুটা বিনা ওষুধে প্রতিরোধ করা যায় সেগুলো হল টবের জন্য যে মাটি ব্যবহার করা হবে তা ভাল করে রোদে শুকানো, ঁিনচু জায়গার মাটি টবের জন্য ব্যবহার না করা, ড্যাম্প ধরা জায়গায় থেকে জৈবিক পদার্থ সংগ্রহ করে তা ভালভাবে রোদে শুকিয়ে ব্যবহার করা।

টবে ফুল গাছের বিভিন্ন ধরনের রোগ দমনের জন্য নানান ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ওষুধ প্রস্তুত করে থাকেন। একই গুণাগুণ সম্পন্ন ওষুধের আলাদা প্রতিষ্ঠানের আলাদা নাম। আর প্রত্যেকটি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রয়োগপদ্ধতি, ওষুধের পরিমাণ সম্বন্ধে জানিয়ে থাকেন। টবের জন্য পরিমাপ নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে। টবের ফুল গাছের জন্য ছত্রাক রোগ মুক্তির সহায়ক কয়েকটি ওষুধের নাম, পরিমাপ ও প্রয়োগ পদ্ধতির বিষয় উল্লেখ করা হল যা ব্যবহার করে ভাল ফল পাওয়া গেছে।

ছত্রাক রোগের ওষুধ প্রয়োগ করার প্রথমে রোগের সম্ভব্য লক্ষণগুলি জানা আবশ্যক। মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণ সার থাকা সত্বেও গাছ নিস্তেজ ও পাতার রং সবুজের পরিবর্তে হলুদাভ, পোকার অনুপস্থিতি সত্বেও গাছ মরে গেলে, বুঝতে হবে শেকড়ে ছত্রাক রোগ আক্রমণের জন্য হচ্ছে। অনেক সময় ছত্রাকের আক্রমণে ছাল উঠে কান্ডে নানাভাবে দাগ পড়ে এবং ধীরে ধীরে ডালগুলো শুকিয়ে যায় ।

কাটিং করার সময় হঠাৎ ডালগুলি নিস্তেজ হয়ে মরে যেতে থাকলে ডালগুলিকে ও চারা তৈরির মাধ্যমকে ছত্রাক রোগ মুক্ত করে নিতে হবে। অনেক সময় ছত্রাক রোগসহ ড্যাম্প ধরা পাতা পচা সার বা গোবর সার ব্যবহার করলে শেকড় নষ্ট হয়ে গাছ সতেজ হয় না ও পাতায় কালো কালো দাগ পড়ে। এ সমস্ত ছত্রাকজনিত রোগ দমন অথবা এর থেকে রেহাই পেতে হলে ব্যাভিস্টিন প্রতি লিটার পানির সাথে দু‘ গ্রাম হারে মিশিয়ে হ্যান্ড ¯েপ্রয়ারের সাহায্যে যতগুলি সম্ভব গাছকে সম্পূর্নরুপে ভিজিয়ে দিতে হবে। এ কাজটি করতে হবে প্রথমে ১৫ দিন অন্তর পরে মাসে একবার।
গাছ কম বেশি হলে কম বেশি পরিমাণ ওষুধ নিতে হবে। ব্যাভিস্টিন ছাড়া কপার অক্সিক্লোরাইড প্রতি লিটার পানিতে চার গ্রাম হিসেবে গুলে একই নিয়মে দিতে হবে ।

অথবা ডায়াথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে দুই গ্রাম হারে গুলে একইভাবে দিতে হবে। এছাড়া আরও কয়েক রকমের ছত্রাকনাশক থাকলেও কার্যকারিতা প্রায় সবেরই একই রকম। উল্লেখিত ওষুধের যে কোন একটি ব্যবহারেই সুফল পাওয়া যাবে।

গাছে পোকা লাগলে অতি সহজেই তা বোঝা যায়। পোকায় পাতা খেয়ে নেয়। কখনও পাতার তলার সবুজ অংশ খেয়ে নেবার ফলে পাতায় সাদা দাগ পড়ে, পাতা শুকিয়ে ঝরে যায়। টবের উপর মল পড়ে থাকা দেখে সহজেই শুঁয়ো জাতীয় পোকা ধরেছে বোঝা যায়। এফিডের বাসা সাদা তুলোর টুকরোর মতো ডালে জড়িয়ে থাকে। কয়েকরকম পোকা ডাল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে গাছ মেরে ফেলে।

মাইটস দ্বারা চন্দ্রমল্লিকা,ডালিয়া,গাঁদ প্রভূতি গাছ খুব বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়। অন্যান্য গাছের তুলনায় এই মাকড় পাতার রস চুসে খেয়ে নেবার পর পাতার তলায় সাদা সাদা দাগ পড়ে শুকিয়ে যায়। মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ জাল গাছে দেখা যায়।এই মাকড় দমনের জন্য শতকরা ৮০ ভাগ সালফার জাতীয় ওষুধ যেমন থিওভিট প্রতি লিটারে ২ গ্রাম হিসেবে ¯েপ্র করতে হবে। এ কাজটি ১৫ দিন অন্তর করলে গাছের মাকড়ের আক্রমন কমে যাবে। ডালে তুলোর মতো পোকার বাসা থাকলে ম্যালাথিয়ন কুড়ি ফোঁটা এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সপ্তাহে একবার দিলেই সব পোকা মরে যাবে। শুঁয়োপোকা বা পাতা খেয়ে নেয়া এমন পোকা মারতে ম্যালাথিয়ন ব্যবহার করা যাবে। ডাল ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে গাছ নষ্ট যাতে না করতে পারে তার জন্য সুমিসিডিন বা রিপকর্ড নামক ওষুধের দশ ফোটা এক লিটার পানিতে গুলে সপ্তাহে একবার গাছে দিতে হবে। এ ছাড়া টবে গাছ বসানোর সময় প্রতি টবে চা চামচের চার ভাগের একভাগ ফুরাডানের দানা ছড়িয়ে দেওয়া সব থেকে নিরাপদ। ছত্রাক বা পোকা গাছের বৃদ্ধি, সৌন্দর্য ও বাঁচার পক্ষে ক্ষতিকারক। এই জন্য প্রথম থেকেই গাছ লাগালোর পরিবেশ হওয়া উচিত আলো বাতাসযুক্ত পরিস্কার, সম্ভব হলে গাছ লাগালোর সময়ই গাছকে ছত্রাক নিবারক করার ওষুধে ধুয়ে নিতে হবে। লাগানোর পর নিয়মিত ১৫ দিন অন্তর পোকা মারার ওষুধ দিতে হবে। প্রথম অবস্থাতেই কাজগুলি করা সহজ। এতে গাছও সুন্দর সজীব থাকে। অবহেলার কারনে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হওয়া গাছকে রোগ মুক্ত করা মোটেই সহজ কাজ নয়।

সহায়িকাঃ
১. ফুল পাতা বনসাই, জগন্নাথ মুখোপাধ্যায়, আনান্দ পাবলিসার্স প্রাইভেট লিমিেিটড, ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা-৭০০০০৯. পাতা ১১-২৬।
২. টবে ও আঙ্গিনায় ফুলের বাগান, কৃষিবিদ দীলিপ কুমার চক্রবর্তী, কৃষিবিদ আবুল কালাম,কৃষি লেখক ফোরাম, খামারবাড়ি ফার্মগেট ঢাকা-১২১৫। পাতা ৩২-৩৪।
৩. উদ্ভিদের ব্যাধি, এস কে চক্রবর্তী, ভারতী বুক স্টল, ৬ বি রমনাথ মজুমদার স্ট্রীট, কলকাতা-৯ পাতা ২১০-২২৮।
৪. অন্নদাতা, ই টি ভি বাংলা।