স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে কৃষির অগ্রযাত্রা

সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশের মাটি কৃষি পণ্য উৎপাদনের এক সমৃদ্ধ আধার। এ দেশের কৃষকের শক্ত হাতে ধরা লাঙল কৃপনা ধরনীর কঠিন মাটি চিরে নতুন ফসলের অযুত সম্ভাবনায় দেশকে সমৃদ্ধ করছে বারংবার। ‘বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে’ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অন্যতম এই স্লোগানটি সে সময় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছিল বহুলাংশে। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে পাওয়া না পওয়ার হিসেবের খাতায় অনায়াসে স্বাধীনতার পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর তুলনাচিত্র উঠে আসে সহজেই।

হাজার বছর ধরে বহিঃশত্রুর নিকট এই সুফলা মাটির প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। তাইতো আপোষের পরিবর্তে হত্যা ও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে জেনারেল টিক্কাখান তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিল ‘এ দেশের মাটি চাই, মানুষ নয়’ অপর দিকে দেশে ও জাতির অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর অনুধাবনে সর্বদা ছিল মাটি ও মানুষ সর্বোপরি আমাদের সোনার বাংলার সার্বভৌমত্ব। তিনি সবসময় বলতেন “আমাদের চাষীরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেনী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়েজিত করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থার পুর্নবিন্যাস সাধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভুমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি ও সরকারি খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করতে হবে।” এভাবে ভূমিসত্ব আইন জারি করে তিনি পরিবার প্রতি ভূমি মালিকানা ৩৭৫ একর থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং আরোপ করেন। গরীব কৃষকের জন্য খাজনা মওকুফ করেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষনিক আমদানির মাধ্যমে ও স্বল্পমেয়াদে উন্নত চাষাবাদের প্রেক্ষিতে উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেন এবং সেই সাথে কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। এই দূরদর্শী চিন্তাধারার ফলাফলই হল স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর কৃষির আকাশ পাতাল পার্থক্যের ফলাফল। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমিতে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল গড় দশমিক ১৮ হেক্টর । কৃষিতে ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত থাকার পরও দানাজাতীয় ফসলের উৎপাদন থেকে বার্ষিক দেশজ চাহিদার মাত্র ৬০ শতাংশ মেটানো যেত । বাকি ৪০ শতাংশের জন্য নির্ভর করতে আমদানির উপর। আর ফুল, ফল, দুধ, ডিম , মাংস ইত্যাদির উৎপাদন ছিল মূলত পারিবারক চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আমাদের কৃষি চিত্র হয়ে উঠেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত, গ্রামীন জীবন হয়ে উঠেছে বণিল। মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি কমে ৮ হেক্টরে নেমে আসা এবং ক্রমবর্ধমান ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাড়তি চাপ মোকাবেলা করেও গত বছর ৪ কোটি ৯ লাখ হে. (সূত্র: কৃষি বর্ষগ্রন্থ- ২০১৯) দানাজাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়েছে যা পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিনগুন। মোট জাতীয় আয় ১৯৭২ সালের ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে এ বছরে ৩১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যার শতকরা ১৩ ভাগ এসেছে কৃষি থেকে। (সূত্র: অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০২০) শুধু দানাদার ফসল নয় ফলমূল, শাক সবজি, ডাল, মশলা, তেল, মাছ, মাংস সহ প্রায় সহ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফসলের জাত উদ্ভাবনে, ইলিশ উৎপাদন ও পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের মাঝে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এছাড়ও পাট, ধান, সবজি, আল, আম, পেয়ারা, চা সহ অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সূচকের উর্ধ্বক্রমে।

এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির সূচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাস্তবধর্মী ও কৃষকদরদী নীতির ফলে। সেই নীতি নির্ধারনের হাত ধরে বর্তমান সরকার গ্রহন করেছে কল্যানধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ন নীতি কৌশল যা বঙ্গবন্ধুরই কৃষি ভাবনার প্রতিফলন। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্জন করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাড়ানোর প্রত্যয়ে উন্মুখ সেই সময় বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রথম সবুজ বিপ্লবের ডাক দয়েছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার মহান পিতার ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিল্পবের ধারনা নতুন করে প্রাণ পায়। খাদ্য উৎপাদনের নতুন যুগের সূচনা হয় জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর নিমিত্তে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তিনি সার বীজ, সেচ, বিদ্যুত প্রভৃতিতে ভর্তুকি দেন এবং এগুলোকে সহজপ্রাপ্ত করে তোলেন। এছাড়াও দেশে প্রথমবারের মত হাইব্রীড ধানে প্রচলন, উচ্চফলনশীল জাতের ব্যাপক সম্প্রসারণও তার হাত ধরে হয়। এই বলিষ্ঠ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলাফল হিসেবে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারর মত খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের খাদ্য ও পুষ্টি সংস্থা থেকে সোরস পুরষ্কার লাভ করেন।
মুজিব বর্ষের প্রাক্কালে করোনার নির্মম আঘাতে বিশ্ব যখন পর্যদুস্ত, ঘোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির তখনও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনীতি যেন আবার পুনজীবিত হচ্ছে। ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে’ এই দূরদর্শী নির্দেশনা বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ সকল দপ্তর/সংস্থা কৃষকের পাশে থেকেছে সবসময়। এপ্রিল মে ২০২০ এ যখন শ্রমিকের অভাবে হাওড়ে ধান কাটা অনিশ্চত হয়ে দাড়ায় তখন মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ধানকাটা নিশ্চিত করনে ২০০ কোটি টাকা জরুরি বরাদ্দ প্রদান করেন। এর ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় ১৩০০ টি উন্নতমানের কম্বাইন হার্ভেস্টার, ৯৩৪ টি রিপেয়ার সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হাওড়অঞ্চল সহ সারাদেশে কৃষকের মাঝে সরবরাহ করে। শ্রমিক সংকট নিরসনে বিভিন্ন এলাকা থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিপুল সংখ্যক শ্রমিক হাওড় এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৯,৯৮১ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫.৩ শতাংস এবং কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি করোনাকালীন সময়ে কৃষির অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে বহুলাংশে।

স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে প্রতিবছর ২.০% এর কম প্রবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে গত দশকে প্রায় ৩% প্রবৃদ্দি হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির সাথে চাল উৎপাদনে জোর দেয়ার কারনে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি অবস্থা অর্জনে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। এই ধারা অব্যহত রাখতে কৃষিতে কতিপয় লক্ষ্যমাত্রার উপর সরকার জোর দিয়েছে। এর মধ্য রয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেয়াদে কৃষিখাতে গড় ৪৫% প্রকৃত প্রবৃদ্ধি অর্জন। (সূত্র: ৬ষ্ঠ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা) কৃষি খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি পরিবারের প্রকৃত আয় টেকসই করা। খাদ্যশস্য উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি কৃষিতে অন্য শস্য ও অর্থকরী ফসলের মধ্যে বৈচিত্র্য আনয়ন, কৃষি মূল্য শৃঙ্খলে বেসরকারি খাতের উৎসাহ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও সমন্বয় করা, কৃষি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চতকরণ, মানসম্মত কৃষি উৎপাদনের জন্য সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ও যথাযথ প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারের যান্ত্রিকীকরণ। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ সহ সামগ্রিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর রূপরেখা, বদলে যাচ্ছে চিরাচরিত ধ্যানধারনার কৃষি। পঞ্চাশবছর আগে পাক হানাদার বাহিনীর দৃশ্যমান শত্রুদের আমরা যেমন অসীম সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছিলাম। ঠিক তেমন আজ করোনার মত অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধেও উৎপাদনের নবনব কৌশল ব্যবহার করে অভিযোজনের নতুন অভিজ্ঞতায় আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত অবস্থান থেকে বাংলাদেশ পৌঁছে গিয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ‘রূপকল্প ২০৪১’ ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জন সহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকার কৃষি খাতে সাফল্যের অব্যহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লাঞ্ছনার নাগপাশ পেরিয়ে নব প্রভাতের মঙ্গল শঙ্খধ্বনিতে আজ আকাশবাতাস মুখরিত।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়:
“এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শুন্যগোলায় ডাকবে ফসলের বান-
পৌষ পাবনে প্রাণ কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান।

আপনার মুল্যবান কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ইমেইল সংরক্ষণ করুন এবং অন্যান্য তথ্য দিন

জনপ্রিয় পোস্ট

শহিদ শেখ রাসেলের সমাধিতে কৃষি তথ্য সার্ভিসের শ্রদ্ধা নিবেদন

স্বাধীনতার অপ্রতিরোধ্য জোয়ারে কৃষির অগ্রযাত্রা

সময় : ০৫:১৭:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৫ জুন ২০২২

সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশের মাটি কৃষি পণ্য উৎপাদনের এক সমৃদ্ধ আধার। এ দেশের কৃষকের শক্ত হাতে ধরা লাঙল কৃপনা ধরনীর কঠিন মাটি চিরে নতুন ফসলের অযুত সম্ভাবনায় দেশকে সমৃদ্ধ করছে বারংবার। ‘বাংলার প্রতি ঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে’ মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অন্যতম এই স্লোগানটি সে সময় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত করেছিল বহুলাংশে। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে পাওয়া না পওয়ার হিসেবের খাতায় অনায়াসে স্বাধীনতার পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর তুলনাচিত্র উঠে আসে সহজেই।

হাজার বছর ধরে বহিঃশত্রুর নিকট এই সুফলা মাটির প্রতি ছিল অমোঘ আকর্ষণ। তাইতো আপোষের পরিবর্তে হত্যা ও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে জেনারেল টিক্কাখান তার সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিল ‘এ দেশের মাটি চাই, মানুষ নয়’ অপর দিকে দেশে ও জাতির অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর অনুধাবনে সর্বদা ছিল মাটি ও মানুষ সর্বোপরি আমাদের সোনার বাংলার সার্বভৌমত্ব। তিনি সবসময় বলতেন “আমাদের চাষীরা হলেন সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেনী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়েজিত করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থার পুর্নবিন্যাস সাধনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন “প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভুমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি ও সরকারি খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বন্টন করতে হবে।” এভাবে ভূমিসত্ব আইন জারি করে তিনি পরিবার প্রতি ভূমি মালিকানা ৩৭৫ একর থেকে কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা সিলিং আরোপ করেন। গরীব কৃষকের জন্য খাজনা মওকুফ করেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষনিক আমদানির মাধ্যমে ও স্বল্পমেয়াদে উন্নত চাষাবাদের প্রেক্ষিতে উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ করেন এবং সেই সাথে কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। এই দূরদর্শী চিন্তাধারার ফলাফলই হল স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর কৃষির আকাশ পাতাল পার্থক্যের ফলাফল। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় ১ কোটি ১০ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমিতে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল গড় দশমিক ১৮ হেক্টর । কৃষিতে ৮০ শতাংশ শ্রমশক্তি নিয়োজিত থাকার পরও দানাজাতীয় ফসলের উৎপাদন থেকে বার্ষিক দেশজ চাহিদার মাত্র ৬০ শতাংশ মেটানো যেত । বাকি ৪০ শতাংশের জন্য নির্ভর করতে আমদানির উপর। আর ফুল, ফল, দুধ, ডিম , মাংস ইত্যাদির উৎপাদন ছিল মূলত পারিবারক চাহিদা মেটানোর প্রয়াসে।
আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর আমাদের কৃষি চিত্র হয়ে উঠেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত, গ্রামীন জীবন হয়ে উঠেছে বণিল। মাথাপিছু চাষযোগ্য জমি কমে ৮ হেক্টরে নেমে আসা এবং ক্রমবর্ধমান ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাড়তি চাপ মোকাবেলা করেও গত বছর ৪ কোটি ৯ লাখ হে. (সূত্র: কৃষি বর্ষগ্রন্থ- ২০১৯) দানাজাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়েছে যা পঞ্চাশ বছর আগের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিনগুন। মোট জাতীয় আয় ১৯৭২ সালের ৩ বিলিয়ন থেকে বেড়ে এ বছরে ৩১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যার শতকরা ১৩ ভাগ এসেছে কৃষি থেকে। (সূত্র: অর্থনৈতিক সমীক্ষা- ২০২০) শুধু দানাদার ফসল নয় ফলমূল, শাক সবজি, ডাল, মশলা, তেল, মাছ, মাংস সহ প্রায় সহ পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ফসলের জাত উদ্ভাবনে, ইলিশ উৎপাদন ও পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের মাঝে প্রথম স্থানে উঠে এসেছে। এছাড়ও পাট, ধান, সবজি, আল, আম, পেয়ারা, চা সহ অন্যান্য কৃষি পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সূচকের উর্ধ্বক্রমে।

এই অভূতপূর্ব অগ্রগতির সূচনা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাস্তবধর্মী ও কৃষকদরদী নীতির ফলে। সেই নীতি নির্ধারনের হাত ধরে বর্তমান সরকার গ্রহন করেছে কল্যানধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ন নীতি কৌশল যা বঙ্গবন্ধুরই কৃষি ভাবনার প্রতিফলন। কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্জন করে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাড়ানোর প্রত্যয়ে উন্মুখ সেই সময় বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে প্রথম সবুজ বিপ্লবের ডাক দয়েছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার মহান পিতার ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তার হাত ধরে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিল্পবের ধারনা নতুন করে প্রাণ পায়। খাদ্য উৎপাদনের নতুন যুগের সূচনা হয় জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর নিমিত্তে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে তিনি সার বীজ, সেচ, বিদ্যুত প্রভৃতিতে ভর্তুকি দেন এবং এগুলোকে সহজপ্রাপ্ত করে তোলেন। এছাড়াও দেশে প্রথমবারের মত হাইব্রীড ধানে প্রচলন, উচ্চফলনশীল জাতের ব্যাপক সম্প্রসারণও তার হাত ধরে হয়। এই বলিষ্ঠ ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের ফলাফল হিসেবে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারর মত খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের খাদ্য ও পুষ্টি সংস্থা থেকে সোরস পুরষ্কার লাভ করেন।
মুজিব বর্ষের প্রাক্কালে করোনার নির্মম আঘাতে বিশ্ব যখন পর্যদুস্ত, ঘোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মাঝে পুরো বিশ্ব যখন স্থবির তখনও আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে অর্থনীতি যেন আবার পুনজীবিত হচ্ছে। ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে’ এই দূরদর্শী নির্দেশনা বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয় ও তার অধীনস্থ সকল দপ্তর/সংস্থা কৃষকের পাশে থেকেছে সবসময়। এপ্রিল মে ২০২০ এ যখন শ্রমিকের অভাবে হাওড়ে ধান কাটা অনিশ্চত হয়ে দাড়ায় তখন মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত ধানকাটা নিশ্চিত করনে ২০০ কোটি টাকা জরুরি বরাদ্দ প্রদান করেন। এর ফলে কৃষি মন্ত্রণালয় ১৩০০ টি উন্নতমানের কম্বাইন হার্ভেস্টার, ৯৩৪ টি রিপেয়ার সহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হাওড়অঞ্চল সহ সারাদেশে কৃষকের মাঝে সরবরাহ করে। শ্রমিক সংকট নিরসনে বিভিন্ন এলাকা থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিপুল সংখ্যক শ্রমিক হাওড় এলাকায় সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটে কৃষিখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৯,৯৮১ কোটি টাকা যা মোট বাজেটের ৫.৩ শতাংস এবং কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি করোনাকালীন সময়ে কৃষির অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে বহুলাংশে।

স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে প্রতিবছর ২.০% এর কম প্রবৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে গত দশকে প্রায় ৩% প্রবৃদ্দি হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির সাথে চাল উৎপাদনে জোর দেয়ার কারনে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি অবস্থা অর্জনে বাংলাদেশ সক্ষম হয়েছে। এই ধারা অব্যহত রাখতে কৃষিতে কতিপয় লক্ষ্যমাত্রার উপর সরকার জোর দিয়েছে। এর মধ্য রয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা মেয়াদে কৃষিখাতে গড় ৪৫% প্রকৃত প্রবৃদ্ধি অর্জন। (সূত্র: ৬ষ্ঠ পঞ্চবাষির্কী পরিকল্পনা) কৃষি খামারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে কৃষি পরিবারের প্রকৃত আয় টেকসই করা। খাদ্যশস্য উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি কৃষিতে অন্য শস্য ও অর্থকরী ফসলের মধ্যে বৈচিত্র্য আনয়ন, কৃষি মূল্য শৃঙ্খলে বেসরকারি খাতের উৎসাহ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ ও সমন্বয় করা, কৃষি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চতকরণ, মানসম্মত কৃষি উৎপাদনের জন্য সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত করার পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ও যথাযথ প্রযুক্তির মাধ্যমে খামারের যান্ত্রিকীকরণ। কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ সহ সামগ্রিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর রূপরেখা, বদলে যাচ্ছে চিরাচরিত ধ্যানধারনার কৃষি। পঞ্চাশবছর আগে পাক হানাদার বাহিনীর দৃশ্যমান শত্রুদের আমরা যেমন অসীম সাহসিকতার সাথে মোকাবেলা করেছিলাম। ঠিক তেমন আজ করোনার মত অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধেও উৎপাদনের নবনব কৌশল ব্যবহার করে অভিযোজনের নতুন অভিজ্ঞতায় আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে আখ্যায়িত অবস্থান থেকে বাংলাদেশ পৌঁছে গিয়েছে মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের ‘স্বপ্নের সোনার বাংলা’ গড়ার প্রত্যয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ‘রূপকল্প ২০৪১’ ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ অর্জন সহ বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সরকার কৃষি খাতে সাফল্যের অব্যহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। লাঞ্ছনার নাগপাশ পেরিয়ে নব প্রভাতের মঙ্গল শঙ্খধ্বনিতে আজ আকাশবাতাস মুখরিত।

সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলতে হয়:
“এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শুন্যগোলায় ডাকবে ফসলের বান-
পৌষ পাবনে প্রাণ কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান।